বাংলাদেশ ব্যাংক

ঋণ বিতরণে পিছিয়ে ১২ ব্যাংক

দেশের খাদ্য উৎপাদনের বিস্তার ঘটাতে চলতি অর্থবছর ব্যাংকগুলোকে ৩৮ হাজার কোটি টাকার কৃষি ও পল্লীঋণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকগুলো ২৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রা ৬৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। যদিও এই সময়ে দুটি ব্যাংক কোনো ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। আরও দুটি ব্যাংকের ঋণ বিতরণের পরিমাণ ১০ শতাংশেরও কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, কৃষিঋণ বিতরণে পরিমাণের পাশাপাশি মানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। যাতে সব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ করে সে জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পল্লী অঞ্চলে নিজস্ব শাখা নেই, সেসব ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার বা এনজিও মাধ্যমে বিতরণ করে সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (এমআরএ) নিবন্ধিত ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুদ নির্ধারণেও এমআরএ নির্ধারিত সুদহারের চেয়ে বেশি সুদ না নিতে পারে সেজন্যও নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) দুটি ব্যাংক কৃষি ও পল্লী খাতে কোনো ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। ব্যাংক দুটি হচ্ছে বেসরকারি খাতের পদ্মা ব্যাংক এবং বিদেশি ওরি ব্যাংক। এছাড়া অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ১০ শতাংশেরও কম ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকগুলো হচ্ছে, বেসরকারি খাতের ইউনিয়ন ব্যাংক এবং বিদেশি এইচএসবিসি। এছাড়া ১৫ শতাংশের কম বিতরণ করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসরকারি মধুমতি ব্যাংকের ১২ দশমিক ৯৭ শতাংশ শরীয়াহ ভিত্তিক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক বিতরণ করেছে ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং আইএফআইসি ব্যাংক বিতরণ করেছে ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। একই সময়ে ২০ শতাংশ বা তার কম ঋণ বিতরণ করেছে সাউথইস্ট ব্যাংক (১৬ দশমিক ২১) এবং সিটিজেন ব্যাংক (২০ শতাংশ)।

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট কাজে অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য মোট ঋণের অন্তত ২ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে। যেসব ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কৃষিঋণ বিতরণ করবে না, তাদের জরিমানার ব্যবস্থা রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে সেসব ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার অর্থ বিতরণে ব্যর্থ হবে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট তহবিলে ওই অর্থ জমা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এর ফলে প্রতি বছরই সাধারণ ঋণ বিতরণের পাশাপাশি বাড়ছে কৃষিঋণ বিতরণ।

এ জন্য বছরের শুরুতে লক্ষ্যও ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। যাতে বছরের বারো মাস বিশেষ করে ফসল চাষের শুরুতে কৃষকরা সময় মতো ঋণ পান। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার কোটি টাকারও কম। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বিতরণকৃত কৃষি ও পল্লীঋণের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১০ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। এছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলো ৯৬৫ কোটি এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১৩ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আলোচ্য সময়ে ২০ শতাংশের বেশি কিন্তু ৫০ শতাংশের কম ঋণ বিতরণ করেছে মোট ১২টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড, প্রিমিয়ার, গ্লোবাল ইসলামী, যমুনা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, এনসিসি, শাহাজালাল ইসলামী, স্যোসাল ইসলামী, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স, ডাচ বাংলা এবং এক্সিম ব্যাংক।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কৃষিঋণ বিতরণের পাশাপাশি কৃষকের ফেরত দেওয়া ঋণের হার সন্তোষজনক। আবার কৃষিঋণে খেলাপি কৃষকের হারও তুলনামূলক কম। তথ্য বলছে, কৃষিঋণে খেলাপির হার ৯ দশমিক ০৬ শতাংশ। মার্চ শেষে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। এ মধ্যে খেলাপির পরিমাণ মাত্র ৫ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ব্যাংকাররা বলছেন, কৃষকরা কখনো ঋণ জালিয়াতি করেন না। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে মাঝে মাঝে সমস্যায় পড়েন তারা। কিন্তু দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপের মতো ঋণখেলাপির প্রবণতা তাদের মধ্যে একেবারেই নেই। তবুও কৃষকদের স্বল্প অর্থের ঋণ আদায়ে বেশি তৎপর ব্যাংকগুলো।

তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে ২৭ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। আর মার্চ শেষে এই খাতে বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ২২৯ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছর ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৩ শতাংশ ঋণ মৎস্য খাতে দিতে হবে। প্রথম ৯ মাসে এই খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর লক্ষ্যমাত্রার অন্তত ১৫ শতাংশ ঋণ দেওয়ার কথা প্রাণিসম্পদ খাতে। আলোচ্য সময়ে পশুসম্পদ ও পোলট্রি খাতে বিতরণ করা হয়েছে ৬ হাজার ১১০ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ২৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এছাড়া নয় মাস শেষে দারিদ্র্য বিমোচনে ৯৯৪ কোটি, শস্য খাতে ১১ হাজার ৬৭৫ কোটি, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১৭৬ কোটি, সেচ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১৬০ কোটি, শস্য গুদামজাত ও বিপণন খাতে ৮৯ কোটি এবং মৎস চাষে ৩ হাজার ৭২৩ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো।