রাজধানীতেই গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংক

- রাজধানীর শাখাগুলোতেই গ্রাহকদের সঞ্চিত টাকা ফিরত দিতে পারছে না আইসিবি ইসলামী ব্যাংক
- কিস্তিতে ধীরে ধীরে পরিশোধ করছে পদ্মা ব্যাংক
- একীভূত আতঙ্কে টাকা উত্তোলন শুরু হলেও এখন কিছুটা কমেছে ন্যাশনাল ব্যাংকে
- কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে টাকা পরিশোধ করছে ইসলামী ধারার ৭ ব্যাংক
- লেনদেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম বেসিক ব্যাংকে, চেয়েছে সরকারের কাছে সহায়তা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল নীতি ও ব্যাংকে ব্যাংকে লুটপাটের খবরে খাতটির উপর আস্থা হারাচ্ছে আমানতকারীরা। এতে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে ভয়বহ তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, শরীয়াহ ভিত্তিক আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, বেসরকারি খাতের পদ্মা, ন্যাশনালসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফিরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আইসিবি ইসলামী ব্যাংক কোন গ্রাহককেই টাকা ফিরত দিতে না পারলেও কিস্তিতে ফেরৎ দিচ্ছে পদ্মা ব্যাংক। একীভূত আতঙ্কে আড়াই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বেসিক ব্যাংকের গ্রাহকরা। এতে লেনদেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম ব্যাংকটিতে। একই আতঙ্কে আমানতকারীরা টাকা উত্তোলন শুরু করলেও এখন কিছুটা স্বাভাবিক ন্যাশনাল ব্যাংকে।
আফসার উদ্দিন। ইতালির প্রবাসী। ১৯৯৮ সালে আল-বারাকাহ ব্যাংক লিমিটেডে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন (বর্তমানে আইসিবি ইসালামি ব্যাংক) তিনি। তখন থেকেই এই ব্যাংকে লেনদেন করেন। আইসিবি ইসলামি ব্যাংক হওয়ার পর ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা জমা করেন। বর্তমানে তা ৭ লাখ ২৩ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এখন প্রয়োজনে টাকা উঠাতে এসে পড়েছেন বিপাকে। ব্যাংকটির মতিঝিলের প্রিন্সিপাল শাখায় এক মাসে তিনবার এসেও টাকা উঠাতে পারছেন না। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা আশ্বাসই দিয়েই যাচ্ছেন। তবে কবে নাগাদ টাকা দিতে পারবে তার কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছে না। এমনকি ব্যাংকটির এ শাখার ম্যানাজারকেও খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।
এ শাখায় গ্রাহক সেজে এই প্রতিবেদক টাকা তুলতে গেলে একজন নারী কর্মকর্তা বলেন, ক্যাশে সমস্যা আছে। এখন টাকা তোলা যাবে না। শাখার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি জানান, ম্যানাজার বাইরে গেছে। কখন আসবে জানি না।
তবে এ শাখায় সিকিউরিটি গার্ড জানায়, ম্যানেজার অফিস করেন না। গ্রাহকরা টাকা তোলার জন্য আসে। তিনি টাকা দিতে না পেরে অফিস আসা বিরত রাখছেন।
শুধু মতিঝিল প্রিন্সপাল শাখায় নয়। ব্যাংকটির নয়াপল্টন ভিআইপি শাখায় একই চিত্র দেখা যায়। এই শাখায়ও কয়েকজন গ্রাহক ম্যানাজারের পেছনে পেছনে ঘুরছেন তাদের জমাকৃত টাকা উত্তোলনের জন্য।
এই শাখায় আসা জাকির হোসেন নামে এক গ্রাহক গত বৃহস্পতিবার জানান, ব্যাংকের ভল্টে টাকা নেই, তাই ম্যানেজার কেবল আশ্বাসই দিচ্ছেন। গত ঈদের আগে এই ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা আসে। ব্যাংক থেকে আজ-কাল বলে শুধু ঘুরাচ্ছে। কিন্তু টাকা দিতে পারছে না। এমনকি ৫ হাজার টাকা চাইলাম সেটাও দিতে পারলো না। তিনি বলেন, ফকিরাপুলে আমার একটা ছাপাখানা আছে। কয়েকজন কর্মচারী আছে। অথচ তাদের বেতন দিতে পারছি না। জাকির ৭ বছর ধরে লেনদেন করেন। আছি খুব বিপদে। এগুলো কি বাংলাদেশ ব্যাংক দেখে না। সরকার কী করে? এটা কোন ধরনের কথা নিজের টাকা তুলতে পারছি না।
আক্ষেপ করে আরেক গ্রাহক গোলাম মোস্তফা বলেন, ১০ বছর ধরে আমার অ্যাকাউন্ট এই ব্যাংকে। কুমিল্লা থেকে ৪ লাখ টাকা পাঠিয়েছে এক ক্লায়েন্ট। তাকে বললাম আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা না পাঠাতে। কিন্তু সে টাকা পাঠিয়ে আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলেছে। তিনি বলেন, ৫০ হাজার টাকা তুলতে এসেছি। কিন্তু টাকা দিতে পারছে না।
শুধু জাকির বা মোস্তফা নয় এই শাখাটিতে বৃহষ্পতিবার সকাল থেকে যতজন গ্রাহক এসেছেন তাদের কাউকেই কোনো টাকা দিতে পারেনি ব্যাংকটি। গ্রাহকদের অভিযোগ গত এক মাস ধরে ব্যাংকে ঘুরাঘুরি করেও তুলতে পারছেন না কোনো টাকা। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দিচ্ছেন মিথ্যা আশ্বাস। নিজের টাকা উঠাতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন গ্রাহকরা। জানান হতাশার কথা। তবে এ বিষয়ে ব্যাংকের শাখাগুলোর ম্যানেজাররা কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বলেন হেড অফিসে যোগাযোগ করতে।
সূত্র জানায়, গুরুতর তারল্য সংকটে পড়ে গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতমুক্ত তারল্য সহায়তা হিসেবে ৫০ কোটি টাকা চেয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ইতোমধ্যে ব্যাংকটির ৪২৫ কোটি টাকা দেনা রয়েছে বলে আবেদনের দুই সপ্তাহ পরে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন ডিপার্টমেন্ট ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্টকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। কারণ এটি তারল্য সংকটের কারণে কার্যত বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যাংকটি জমাকৃত আমানত, মূলধনের ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং তারল্য সংকটের কারণে পদ্ধতিগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষের দিকে ব্যাংকটি ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পরে। তাদের মোট ৭৯০ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণের ৮৭ শতাংশই খারাপ ঋণ। বর্তমানে তাদের ৩৩টি শাখায় ৩৫০ জন কর্মচারী রয়েছে বলে জানান আইসিবি ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
আইসিবির একাধিক কর্মকর্তার মতে, বেশ কিছুদিন ধরে ব্যাংকটি কর্মীদের পুরো বেতন দিতেও হিমশিম খাচ্ছে।
জানা যায়, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও সৌদি আরবের দাল্লাহ আল-বারাকাহ গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে ১৯৮৭ সালের ২০শে মে দেশে কার্যক্রম শুরু করেছিল আল-বারাকাহ ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ২০০৪ সালে মালিকানা পরিবর্তন করে নাম দেয়া হয় ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’। মালিকানা হস্তান্তরের পর ২০০৬ সালে সীমাহীন ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ব্যাংকটিতে। ভুয়া নথি আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে তৎকালীন উদ্যোক্তারা হাতিয়ে নেন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। চলে নজিরবিহীন লুটপাট। ফলে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ ও পর্ষদ ভেঙে দিয়ে ওরিয়েন্টাল ব্যাংককে পুরোপুরি অধিগ্রহণ করে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শৃঙ্খলা ফেরাতে সেখানে প্রশাসক বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন করে পুনর্গঠন করতে হয় ব্যাংকটি। ২০০৭ সালের আগস্টে ব্যাংকটির অধিকাংশ শেয়ার বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনাকারী সুইস আইসিবি গ্রুপের সঙ্গে দরপত্রে অংশ নেন দুজন দরদাতা। ২০০৮ সালে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়।
এদিকে বেসরকারি খাতের পদ্মা ব্যাংক গ্রাহকের টাকা দিচ্ছে কিস্তিতে। ব্যাংকটির দিলকুশা শাখায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রাহকরা টাকার জন্য অপেক্ষা করছেন। গ্রাহক যত টাকা তোলার চাহিদা দিচ্ছেন। কিন্তু ব্যাংক গ্রাহকের চাহিদার অর্ধেক দিচ্ছেন। বাকিটা পরবর্তীতে নেয়ার জন্য বলা হয়।
শাখার ম্যানেজার মনির হোসেন বলেন, গ্রাহক টাকা তুলতে আসলে ফেরত যাচ্ছে না। তবে যা চাহিদা দিচ্ছে। তার অর্ধেক বা তারচেয়ে কম দিচ্ছি। বিভিন্ন তারিখ দিয়ে দিচ্ছি বাকি টাকা নেয়ার জন্য। তিনি বলেন, একীভূত হওয়ার খবর টাকা তোলার একটা চাপ ছিল। এখন তা অনেকটা কমে গেছে।
তবে ব্যাংকটির গ্রাম পর্যায়ের বিভিন্ন শাখায় টাকা দিতে সমস্যা হচ্ছে বলে জানা কর্মকর্তারা। তারা বলেন, শহরে এক শাখায় সমস্যা হলে আনঃব্যাংক মাধ্যমে অন্য শাখায় টাকা তোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গ্রামে সেটা করা যাচ্ছে না। তাই তাদের টাকা দিতে সমস্যা হচ্ছে।
নানা সমালোচনার মধ্যেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৩ সালে নতুন ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে একটি ছিল ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক)। নানা অনিয়মের কারণে শুরু থেকেই ধুঁকতে থাকে চতুর্থ প্রজন্মের এ ব্যাংকটি। ফলে ২০১৭ সালে এসে চরম তারল্য সংকটে পড়ে। গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে অনেক আমানতকারী দ্বারস্থ হন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এরকম পরিস্থিতিতে কার্যক্রম শুরুর মাত্র তিন বছর না যেতেই ফারমার্স ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন মহিউদ্দীন খান আলমগীর। একই দিন পদত্যাগ করেন তৎকালীন অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতী।
এরপর ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর একেএম শামীমকে এমডি পদ থেকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধন সহায়তা দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক (সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা) এবং রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। সেই সুবাদে ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হয় ওই চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে দ্য ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। সে সময় ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। যদিও সম্প্রতি এ পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন তিনি।
নতুন নামেও টিকে থাকতে পারল না পদ্মা ব্যাংক। সংকটে থাকা এই ব্যাংক শরিয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নিয়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংক দুটির মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। এরপরই আতঙ্ক বাড়ে আমানতকারীদের। যার প্রভাবে পদ্মা ব্যাংক থেকে ওই সময় টাকা তোলার হিড়িক শুরু হয়। যদিও বর্তমানে তার প্রভাব কিছুটা কমেছে।
অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের একীভূত হওয়ার খবরে ব্যাংকটি থেকে আমানতকারীরা ইতিমধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বেসিক ব্যাংক চরম তারল্যসংকটে পড়েছে। ব্যাংকটি অন্য কোনো ব্যাংক থেকে টাকা ধার পাচ্ছে না, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিশেষ কোনো সহায়তা করছে না। ফলে গ্রাহকদের টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ব্যাংক যেকোনো মুহূর্তে ব্যর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের কাছে সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিসুর রহমান।
এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকে একীভূত আতঙ্কে গ্রাহকরা টাকা তুলে নেওয়া শুরু করলেও একীভূত না হওয়ার সিদ্ধান্তের পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। ব্যাংকটির দিলকুশ শাখার ব্যবস্থাপক আবদুর রহিম নতুনধ্বনিকে বলেন, আমরা এখন কিছুটা ভালো আছি। মানুষ এখনো টাকা উত্তোলন করতে আসে। তবে আগের থেকে কম। আমাদের কাছে কেউ টাকা চাইলেই আমরা টাকা দেওয়ার চেষ্টা করি। যাতে গ্রাহকরা আস্থা না হারান।