পরিবার চালাতে হিমশিম

  আনিসুর বুলবুল
  প্রকাশিতঃ রাত ০১:০৫, রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০২৪, ৩ চৈত্র ১৪৩০
আনিসুর বুলবুল, মিডিয়া কর্মী
আনিসুর বুলবুল, মিডিয়া কর্মী

দিন দিন ঋণ বেড়েই যাচ্ছে। প্রত্যেক মাসে ক্রেডিট কার্ড থেকে ঋণ নিচ্ছি। তিন মাস পরপর বিকাশ থেকেও। মাস শেষে বিল দিতে গিয়ে জমানো টাকাতেও হাত দিতে হচ্ছে। অথচ বাজারের তালিকা কাটছাঁট করে কমিয়ে দিয়েছি অনেক আগেই। তারপরও চলতে পারছি না। কীভাবে চলব? দিন দিন খরচ যেভাবে বাড়ছে বেতন তো বাড়ছে না।

মাসের শুরুতে বাচ্চাদের স্কুলের টিউশন ফি, অনলাইনে কোচিং, স্কুল বাস, আমাদের যাতায়াত, ওষুধ, কাজের বুয়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ইন্টারনেট, টিভি, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল বিল, সিকিউরিটি, মসজিদ, বাসা ভাড়া— এগুলো দিতে দিতেই মাসের অর্ধেক পর্যন্ত বাজার করা যায় আমাদের দুজনের বেতন দিয়ে। জামা-কাপড়, বাচ্চাদের খেলনা, ঘোরাঘুরি— এসব কয়েক মাস ধরে চলছে ক্রেডিট কার্ড আর জমানো টাকার ওপর।

এভাবে কত দিন চলব? সেদিন হিসেব করে লাইফস্টাইলেই কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই যে— জন্মদিনে কেক কাটা, ছুটির দিনে ঘুরতে যাওয়া, বাইরে খাওয়া, শখ করে কোনো কিছু কেনা, বাচ্চাদের খেলনা, প্রাইভেটকার ব্যবহার, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম— এগুলো বাদ দিয়েছি। বাদ দিয়েছি প্রতি শুক্রবারে মাছ-মাংস কেনাও। শুধু তাই নয়, বাদ দিয়েছি চিপস-বিস্কুট-আইসক্রিম-চা খাওয়াও।

শুধু যে আমার অবস্থা এমন তা নয়। আমার চেয়েও যারা ভালো চলতেন কিংবা ভালো বাজার করতেন। তাদের অবস্থাও আমার মতোই। আগে প্রত্যেক শুক্রবারে বাজার করতে গিয়ে যাদের সঙ্গে দেখা হতো মসজিদে তারাবির সময় তারাও বলছেন; ভাই, চলতে তো পারছি না। বাচ্চার টিউশন ফি এখনো দিতে পারিনি। আমার মতো এই ঈদে নতুন জামা-কাপড় না কেনার সিদ্ধান্ত তারাও নিয়েছেন।

মাস ছয়েক আগেও আমাদের চলতে সমস্যা হয়নি। তাহলে এখন কেন চলতে সমস্যা হচ্ছে? হঠাৎ দেশে এমন কী হলো যে হুট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হুহু করে বেড়ে গেল। বেড়ে গেল বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির দামও। হঠাৎ এমন পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো যে— মানুষের লাইফস্টাইলেও কাটছাঁট করতে হচ্ছে; বাজার করাও কমিয়ে দিতে হচ্ছে; ঋণ করার পাশাপাশি জমানো টাকাতেও হাত দিতে হচ্ছে?

একবার চিন্তা করে দেখেন, আমাদের অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে দিন এনে দিন খান যারা— তাদের অবস্থা এখন কেমন? কীভাবে চলছেন তারা? তারা কি দুই বেলা ঠিকমতো খাবার খেতে পারছেন? বাচ্চাদের লেখাপড়া করাতে পারছেন? মাছ-মাংস কিংবা জামা-কাপড় কেনার কথা বাদই দিলাম। আবার যারা কর্মচ্যুত হয়েছেন— কেমন আছেন তারা? একবার ভাবা যায়!

আমার বাসার বুয়া সেদিন তার মাসের অর্ধেক বেতন অ্যাডভান্স নিয়েছেন; ওষুধ আর চাল কেনার জন্য। কিছু টাকা ধারও চেয়েছেন। সংসার চালাতে আরও দুটো কাজ বাড়তি করছেন তিনি। প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গ্রামে চলে যাবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে কী করবেন ভেবে শহরেই থেকে যান। সারা দিন কাজের পর তার স্বামী এখন রাতে ফুটপাতে কলা বিক্রি করছেন। তারা কিস্তির টাকা পরিশোধ আর বাজার নিয়ে টেনশনে থাকছেন প্রতিদিন।

আজ দেশ রূপান্তরের প্রধান খবর 'খাবারে ঋণ ৪০% পরিবারের'। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশের ৪৩ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করে খাবার কিনতে হয়েছে। এর আগে গত বছর ডিসেম্বরে ঋণ করে খাবার কিনতে হয় ৪০ শতাংশ পরিবারকে। তার আগের মাস নভেম্বরে ঋণ করে খাবার কিনতে হয় ৪২ শতাংশ পরিবারকে।

ডাব্লিউএফপির খাদ্য নিরাপত্তার এই জরিপটি বাস্তবতাকেই তুলে এনেছে। মানুষের আয় যতটা না বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। যেসব পণ্য না কিনলেই নয়, বিশেষ করে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য মানুষ ঋণ করছে কিংবা সঞ্চয় ভাঙছে। দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে খাবারের তালিকা এমনকি লাইফস্টাইলেও কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। এভাবে আর কত দিন?

ফেসবুক থেকে নেয়া 

লেখক: আনিসুর বুলবুল,

অনলাইন এডিটর

দেশ রূপান্তর 

Share This Article