বারবার নীতির পরিবর্তনেও সুশাসন ফেরেনি ব্যাংকে

  আকিব মাহমুদ
  প্রকাশিতঃ রাত ০২:০৭, বুধবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ২৪ মাঘ ১৪৩০
ফাইল  ফটো
ফাইল ফটো

ঋণ বিতরণে ব্তমানে ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) নীতিমালা অনুসনের নির্দেশনা রয়েছে। তার বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর আগে ছিল ক্রেডিট রিস্ক গ্রেডিং (সিআরজি) তারও আগে ঋণ বিতরণে লেন্ডিং রিস্ক এনালইসিসি (এলআরএ) অনুসরনের বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু দিনের পর দিন ঋণ বিতরণের নিয়ম কঠিন হলেও বেড়েছে খেলাপি ও সৃষ্টি হয়েছে বিসৃঙ্খলা


দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা বাস্তবায়নে ব্যাংক কোম্পানি আইন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনসহ বিভিন্ন আইন রয়েছে। এর বাইরে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো গাইডলাইন ও প্রজ্ঞাপন জারি করে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ করে। তেমনি আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ব্যাংক কোম্পানি আইনের পাশাপাশি সময় সময় নীতিমালা (গাইডলাইন ও সার্কুলার) জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৩০ বছরের বিভন্ন সময়ে সংস্থাটি প্রয়োজন অনুযায়ী এরকম নীতিমালা জারি ও পরিবর্তন করেছে। তারপরও ব্যাংকিং খাতের সুশাসন এখন প্রশ্নবিদ্ধ। 
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নীতিমালা করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক রাজনৈতিক ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন খাতের প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে ওই নীতিমালার বাস্তবায়ন করতে পারছে না। বিশেষ করে ব্যাংকে অবৈধ হস্তক্ষেপ করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু এর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এজন্য ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন।
তথ্য বলছে, ঋণ বিতরণে এখন ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) নীতিমালা অনুসনের নির্দেশনা রয়েছে। তার বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর আগে ছিল ক্রেডিট রিস্ক গ্রেডিং (সিআরজি) তারও আগে ঋণ বিতরণে লেন্ডিং রিস্ক এনালইসিসি (এলআরএ) অনুসরনের বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু দিনের পর দিন ঋণ বিতরণের নিয়ম কঠিন হলেও বেড়েছে খেলাপি ও সৃষ্টি হয়েছে বিসৃঙ্খলা। সেই সৃঙ্খলা ফেরাতে আবর নতুন করে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবশেষ গত ৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাংক খাতের খেলাপিদের ধরতে ১১ দফা রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটির বাংলাদেশ ব্যাংক। সুশাসন ও আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা সংস্থাটির প্রধান কাজ। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া উদ্যোগ। সংস্থাপ্রধান গভর্নরের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে অনেক কিছু। কমবেশি হয় দেশের মূল্যস্ফিতি। উঠানামা করে পণ্যমূল্য। পরিবর্তন হয় হাজারো মানুষের কর্মভাগ্য। করোনকালীন সময়ের মতো চাকরি হারায় বহু ব্যাংকরার, আবার টাকা না দিয়েও নিয়মিত গ্রাহক হওয়ার সুযোগ পান প্রভাবশালীরা।
তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের ২০ মার্চ গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন গভর্নর ফজলে কবির।সেই সময়ে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি। তবে ২০২২ সালের ৩ জুলাই তিনি অবসরে যান। সেসময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ২৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সাত বছরে ৬৫ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে খেলাপি।
তথ্যমতে, ফজলে কবিরের আমলে করোনাকালীন নীতিসহ বেশকিছু সুযোগ দেওয়া হয়। পাশাপাশি একাধিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে। মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টের বিপরিতে পূর্বের খেলাপি নিয়মিত করার নীতিমালা জারি করা হয় ২০১৯ সালে। ২০১৯ সালের আগে ঋণ পুনঃতফসিল করার কোনো আগ্র দেখাতো না। কারণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত এককালীন বা ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হতো। কিন্তু খেলাপিদের প্রতি নমনীয় হতে গিয়ে ডাউন পেমেন্টের হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। যদিও ব্যাংকের প্রভাবশালী বড় গ্রাহকরা কোনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়েও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গ্রাহকের অনুকূলে ঋণসীমা বাড়িয়ে দিয়েও ব্যাংকগুলো খেলাপি হওয়ার যোগ্য ঋণকে নিয়মিত দেখাচ্ছে।
তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতের অনিয়ম কমাতে ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে ঋণের ঝুঁকি পরিমাপের নতুন নীতিমালা উদ্বোধন করেন গভর্নর ফজলে কবির। ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) নামের এই নীতিমালায় ঋণের পরিমাণ ও গুণগত উভয় ধরনের সক্ষমতার মূল্যায়ন শর্ত রাখা হয়। মূল্যায়নের ভিত্তিতে গ্রাহককে চার শ্রেণিতে বিভাজন করবে ব্যাংকগুলো। কোনো গ্রাহক ‘চমৎকার’ (এক্সিলেন্ট) বা ‘ভালো’ (গুড) রেটিং পেলে ব্যাংক তাকে অর্থায়ন করতে পারবে। ‘প্রান্তিক’ (মার্জিনাল) রেটিংধারী গ্রাহককে পুরনো ঋণ নবায়ন বা নতুন করে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিংধারীকে কোনো পরিস্থিতিতেই নতুন ঋণ দিতে পারবে না ব্যাংকগুলো, যদি না আগের ঋণ শতভাগ নগদ পরিশোধ হয় অথবা জামানত দিয়ে ঋণটি আচ্ছাদন করা হয়। ‘অগ্রহণযোগ্য’ (আনএকসেপ্টেবল) রেটিংভুক্ত গ্রাহকের আগের ঋণ সর্বোচ্চ দুবার নবায়ন বা বর্ধিত করা যাবে।
এই নীতিমালা জারির পর দেশের আর্থিক খাতে সুশাসন ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছিলো অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু বিভিন্ন মহলের চাপে অল্প সময়ের মধ্যেই ওই নীতিমালায় পরিবর্তন আসে। এরপর একাধিকবার পরিবর্তন আনা হলেও বর্তমানে ওই নীতিমালা কার্যকর রয়েছে। যদিও ওই নীতিমালা কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন অনেক। 
তথ্য বলছে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে ২০২০ সালের পুরো সময়ে ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ পান গ্রাহক। ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নির্ধারিত ঋণের কিস্তির ২৫ শতাংশ জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে বিবেচনার সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পুরো বছরজুড়েই এই সুবিধা ভোগ করেন ব্যাংকের সব গ্রাহক। ২০২২ সালে নূনতম ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসসিলে সুযোগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয় যেসব গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করেন নি, তাদের জন্য ৪ বার ঋণ পুনঃতফসিল বা ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। ঋণ পরিশোধে ২৯ বছর সময় পাবেন। সেই প্রজ্ঞাপন এখনও বহাল।
তদারকি দুর্বলতা ও পরিচালকদের অনিয়মের কারণে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড এখন অবসায়নে। এমন অবস্থা আরও কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও। পিকে হালদারসহ একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় অনুসন্ধানে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ও একন ডেপুটি গভর্নরের সংশ্লিষ্টতাও ছিল পিকে হালদার কান্ডে। কিন্তু এখনও চুড়ান্ত বিচার হয়নি দায়ি ব্যক্তিদের। এছাড়া ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় জোরপূর্বক পরিবর্তনের সময় নতুন চেয়ারম্যান পদে বসেন আরাস্তু খান। এরপর থেকেই শুরু হয় ইসলামী ব্যাংকের অধপতন। এখন ইসলামী একটি দুর্বল ব্যাংকের নাম। মাঝেমধ্যেই ধার করে দৈনিক চাহিদা পুরন করে ব্যাংকটি। এতোকিছু ঘটে গেলেও যেন সমাধান করার কেউ নেই। তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবিরও সামাধান করে যেতে পারেননি। এখনও সমস্যাগুলো অমিমাংশিত।
এর আগে ২০০৫ সালে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে ক্রেডিট রিস্ক গ্রেডিং (সিআরজি) ঘোষণা করেছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত, ওই সময়ে ব্যাংক খাতে নানা অনিয়মসহ বিভিন্ন কারণে সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই জন্যই এই নীতিমালা জারি করেছিলেন গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তারপরও ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পতন ঠেকাতে পারেননি এই গভর্নর। মালিকপক্ষের লুটপাটের কারণে অতিরুগ্ন হয়ে পড়লে ২০০৬ সালের ১৯ জুন ব্যাংকটির দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে মালিকপক্ষের ৮৬ শতাংশ শেয়ারের বড় অংশ কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ। তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে করা হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এখনও ব্যাংকটি রুগ্ন অবস্থায়ই আছে। এই নীতিমালা জারির সময় ব্যাংক খাতে খেলাপির পরিমাণ ছিলো ২০ হাজার ১০ কোটি টাকা। কিন্তু খেলাপি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। গভর্নর হিসেবে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব ছাড়ার সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি বেড়ে দাঁড়িয়েছিলো ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই গভর্নরের ৩ বছরের ব্যাংক খাতে খেলাপি বেড়েছিলো ২ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ১৯৯০ সালে ব্যাংক খাতের খেলাপির পরিমাণ ছিলো ৪ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। ১৯৯২ সালে ঋণ অনিয়মসহ নানা কারণে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) বিলুপ্ত হয়ে ইস্টার্ন ব্যাংক গড়ে উঠেছিল। ওই সময় ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে বড় ধরণের পদক্ষেপের দরকার হয়ে পড়ে। পরে ১৯৯৩ সালে ব্যাংক খাতের খেলাপি বেড়ে ৮ হাজার ৫১৬ কোটি টাকায় দাঁড়ালে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে ১৯৯৩ সালে লেন্ডিং রিস্ক এনালইসিসি (এলআরএ) ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় গভর্নর ছিলেন খুরশিদ আলম। কিন্তু নীতিমালা জারি করেও ব্যাংকের খেলাপি কমানো যায়নি। ১৯৯৬ সালে তিনি দায়িত্ব ছাড়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫৪ কোটি টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আব্দুর রউফ তালুকদার, ফজলে কবির ও ড. আতিউর রহমানের সময় খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এই তিন গভর্নরের আমলে ২২ হাজার ৪৮০ কোটি থেকে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে খেলাপি। হিসাব অনুযায়ী এই তিন গভর্নরের আমলে খেলাপি বৃদ্ধির পরিমাণ এক লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। 
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, একটা সময় ঋণ খেলাপিদের ভয় ছিল। এখন সেটা নেই। কারণ ঋণ খেলাপি হলে নতুন নতুন সুবিধা পাওয়া যায়। স্বল্প টাকার বিনিময়ে খেলাপি হয়ে যায় নিয়মিত ঋণ। এছাড়া আইনের ফাঁক গলিয়ে ঋণ মওকুফের সুবিধাতো রয়েছেই।
আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০২২ সালের ১২ জুলাই। সে সময়ের সবশেষ তথ্যমতে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের আকার ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। খেলাপি কমানের জন্য দায়িত্ব নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই ঋণ পুন:তফসিলে বিশেষ সুবিধা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু সেই নীতিমালা কোনো কাজে আসেনি। বিদায়ী বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতের এই ক্যান্সার এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটিতে পৌঁছায়। অর্থাৎ গ্রাহকদের মধ্যে খেলাপি ঋণের প্রবণতা এতোটাই বেড়েছে যে সুযোগ দিয়েও এই পাগলা ঘোড়ার লাগম টানা যাচ্ছে না। যদিও সেপ্টেম্বরে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায় নেমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে মুল্যস্ফীতি ও ডলার বাজারের অস্থিরতা এখনও সামাল দিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।
ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০০৯ সালে ১ মে। রিজার্ভ চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ পদত্যাগ করেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছিল ৩৬ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। কারণ দায়িত্বের শুরুতে ব্যাংক খাতের খেলাপি ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি এবং পদত্যাগের সময় খেলাপি পৌঁছায় ৫৯ হাজার ৪১১ কোটিতে।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও কৃষকদের মাঝে মহানায়ক হিসেবে পরিচিত সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। কারণ তিনি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক কাজ করেছেন। পক্ষান্তরে ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারিগুলো তার আমালেই সংঘটিত হয়েছে। যেমন, গত এক যুগে সবচেয়ে বেশি আলোচিত রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কারসাজি। ২০১১ সালে হলমার্কসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (হোটেল শেরাটন) শাখা থেকে ঋণের নামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। আলোচিত এ ঘটনায় বাতিল করা হয় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। আটক করা হয় সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও হলমার্কের মালিককে। সেই ঘটনার বিচারকাজ এখনো চলছে। টাকাও আদায় করতে পারছে না সোনালী ব্যাংক।
২০১১-১২ সালে বেসিক ব্যাংকের প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে প্রধান ভূমিকা রাখেন বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। এই টাকা থেকে ১১০ কোটি টাকা দিয়ে ঢাকায় সেনা নিবাসে দেড় বিঘা জমির ওপর একটি বাড়ি কিনেছিলেন তিনি। এত বড় বাড়ি কেনার অর্থ আবদুল হাইয়ের ব্যাংক হিসাবে কীভাবে এসেছিল, তারও বিবরণ বিএফআইইউ পাঠিয়েছিল দুদককে। তবে শেখ আবদুল হাইয়ের কিছুই হয়নি। ব্যাংকও বড় অংশ টাকা আদায় করতে পারেনি।
২০১২-১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপ কয়েকটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। ঘটনা প্রকাশের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান, পরিচালক আনোয়ার চৌধুরী, নওরীন হাসিবসহ ঋণ গ্রহীতারা। ওই কেলেঙ্কারির ঘটনায় ক্ষতিতে পড়ে জনতা, প্রাইম, যমুনা, প্রিমিয়ার ও শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক।
অ্যাননটেক্স গ্রুপের মালিক ইউনুস বাদলেকে মাত্র ৬ বছরে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণ সুবিধা দেয় জনতা ব্যাংক। নিয়মনীতি না মেনে এভাবে ঋণ দেওয়ায় বিপদে ব্যাংক। এখনও সে ঋণ পরিশোধ হয়নি। পাওনা এখন সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি, যার বড় অংশই এখন খেলাপি। ঋণ পুনঃতফসিলে মাধ্যমে এখন দিন চলছে গ্রুপটির। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনে উঠে আসে, অনিয়ম, জালিয়াতি ও তথ্য গোপন করে অ্যাননটেক্স গ্রুপের ২২ প্রতিষ্ঠানকে ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল সময়ে বিপুল অংকের এসব ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক।
ড. আতিউর রহমানের আমলে আরও একটি ঘটনা ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফারমার্স ব্যাংক। চালু হওয়ার তিন বছরের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আর্থিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে। সাড়ে তিন হাজার টাকারও বেশি অঙ্কের ঋণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে ফারমার্স ব্যাংকের গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘুস ও ঋণের ভাগ নেওয়া এবং জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতীর বিরুদ্ধে। পরে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড থেকে তারা পদত্যাগ করেন। ২০১৮ সালে নাফিজ শারাফাত ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ২০১৯ সালে ব্যাংকটি নাম পরবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
খেলাপি ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেশনা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খেলাপি সংস্কৃতি দুর করতে হলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি আদায়ে যেভাবে চেষ্টা করছে। তাতে মাঝে মাঝে উল্টোমূখী ফল ভোগ করছে জনগন। উল্টোমূখী ফলের মধ্যে স্বল্প টাকায় ঋণ পুনঃতফসিলের সিদ্ধান্ত একটি। আমাদের দেশে যেসব আইন আছে তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। ফলে ঋণ ফেরত না দিয়ে আবার ক্ষেত্রে বিশেষে বিদেশে পাচার করেও ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে। এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাংক খাতে সুশাসন, শৃঙ্খলা, স্পষ্টতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

Share This Article