নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে আইএফআইসির ৬৯০ কোটি টাকার ঋণ

  বিশেষ প্রতিবেদক
  প্রকাশিতঃ দুপুর ০১:৩৮, সোমবার, ১ জানুয়ারি, ২০২৪, ১৭ পৌষ ১৪৩০

নিজস্ব প্রতিবেদক : ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি খাতের ব্যাংক আইএফআইসি। নির্বাচন এলেই ব্যাংকটির কার্যক্রমে বেশ অস্বাভাবিক আচরণ প্রত্যক্ষ করা যায়। ব্যাংকটির কর্তৃপক্ষ মাত্র এক বছর বয়সী ৪ কোম্পানিকে ৬৯০ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করেছে। যার মধ্যে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে কোম্পানিগুলোর ঋণসীমা বৃদ্ধি করে ব্যাংকটি। যে চারটি কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া হয়েছে সেসব কোম্পানির নেই কোন ওয়েবসাইট। বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া প্রতিবেদনেও দেওয়া হয়নি কোনো ঠিকানা। নিজস্ব অনুসন্ধানেও কোম্পানিগুলোর অফিস খুঁজে পাওয়া যায়নি। পর্ষদ সভার কার্যবিবরণী প্রকাশে অতি গোপনীয়তা পালন করছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, ব্যাংকটির ফেডারেশন শাখার গ্রাহক ব্রাইটস্টার বিজনেস লিমিটেড ২০২৩ সালের ২৭ জুলাই কথিত ব্যবসা শুরু করেছে। একই শাখার অপর গ্রাহক অ্যালট্রন ট্রেডিং লিমিটেড প্রায় একই সময়ে ব্যবসা শুরু করেছে। নাম সর্বস্ব এ দুটি কোম্পানির কোনো ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ছাড়াই দ্রুততার সাথে ৩৪৫ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এরমধ্যে ব্রাইটস্টারকে হিসাব খোলার মাত্র ২০ দিনে ৮৫ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে। অপর কোম্পানি অ্যালট্রনকে হিসাব খোলার ২৭ দিনের মাথায় ৯৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়। ঋণ অনুমোদন করার পরপরই খুবই দ্রুততার সাথে ঋণের টাকাও ছাড় করা হয়।

এর মধ্যে ব্রাইটস্টার করপোরেশন নামে একটি গ্রুপ অব কোম্পানি রয়েছে। ব্রাইটস্টার বিজনেস তাদের প্রতিষ্ঠান কিনা জানতে চাইলে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠান নয় বলে জানিয়েছেন। এছাড়া রাজধানীর পল্টন এলাকায় ব্রাইটস্টার নামে ২০১৪ সালের এন্টিরিওর ডিজাইনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সেটি অল্প দিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ওই সময়ের কর্মকর্তা মো. সেলিমুল্লাহ বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি অল্প দিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে তার কোন কার্যক্রম নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএফআইসি ব্যাংকের ফেডারেশন শাখার প্রধান ব্যবস্থাপক তাসলিমা আকতার বলেন, ঋণ আমরা সকল ধরণের নিয়ম-কানুন মেনেই দিয়েছি। ঋণের অনুমোদন তো আর শাখা থেকে করা হয় না। এটা বোর্ডের কাজ। তবে শাখা থেকে আমাদের যেসব দায়িত্ব ছিলো সেগুলো আমরা পালন করেছি। এর বাইরে কোন তথ্য আপনাকে দিতে পারবো না।

এদিকে, আরো দুটি কোম্পানিকে ৩৪৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ দিয়েছে ব্যাংকটি। এরমধ্যে ফারইস্ট বিজনেস লিমিটেড নামের অপর কোম্পানির ব্যবসা শুরু করার তারিখ দেখানো হয় ২০২২ সালে, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো তারিখও পাওয়া যায়নি। কোম্পানিটি কী পণ্যের ব্যবসা করে তাও উল্লেখ করা হয়নি। এ কোম্পানিকে ১৭৫ কোটির ঋণ প্রদান করা হয়েছে। একই ধরনের অপর কোম্পানি সানস্টার বিজনেস লিমিটেড ব্যবসা শুরু করেছে ২০২২ সালের ২ জুন। এ কোম্পানিকে ১৭০ কোটি টাকার ঋণ প্রদান করা হয়েচেহ। এ চারটি কোম্পানিকে মাত্র চার মাসের মধ্যে ৬৯০ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে, যাকে অবিশ্বাস্য বলছে ব্যাংকিং খাত-সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও ব্যাংক খাত বিশ্লেষক নুরুল আমিন বলেন, এই ধরণের ঋণের ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্বয় বিষয় নয়। আইনে এই ধরণের বিষয় সরাসরি উল্লেখ নেই। তবে ওই ঋণে যা যা করণীয় পালনীয় সেগুলো করা হয়েছে কিনা তা দেখতে হবে। যারা ভালো ব্যবসায়ী তাদের লাইসেন্স ১-২ মাস আগের হবে কেন? এজন্য যখন ঋণ দেওয়া হবে তখন দেখতে হবে এটা কি ধরণের প্রতিষ্ঠান। এটা আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কিনা, স্ট্যাটাপ কিনা বা আইটি কোম্পানি কিনা। এছাড়াও এটা কি এমন কোম্পানি কিনা যে তার আমদানি দেরি হলে পণ্য সংকট তৈরি হবে বা অন্য কিছু। এসব কিছু না হয়ে যদি নতুন প্রতিষ্ঠান হয় তাহলে বুঝতে হবে এই ঋণে সমস্যা আছে। অল্প সময়ের মধ্যে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এই ঋণে গ্রাহক কারা তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারবে কিনা সেগুলো খতিয়ে দেখা কঠিন। তারপরও যদি ঋণ বিতরণ করা হয় তাহলে ওই ঋণের বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে। আর এসব ঋণই খেলাপি হয়ে পড়ে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুসরাত রহমান ও রুবাইয়া আল মাসুম ২০২২ সালে কোম্পানি দুটি গঠন করেন। তারা দুজনই ৭ থেকে ৮ বছর ধরে ট্রেডিং, বিতরণ, আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রমের সাথে জড়িত আছেন বলে উল্লেখ করেছেন। তবে, তারা ঋণ আবেদনের সাথে তাদের অভিজ্ঞতার কোনো কাগজপত্র কিংবা প্রমাণ দাখিল করেননি এবং আমদানি-রপ্তানির কোনো প্রমাণ সরবরাহ করেননি।

নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার মাত্র ২০ থেকে ২৭ দিনের মধ্যেই ১৮০ কোটি টাকা অনুমোদনের মাত্র চার মাসের মধ্যেই ওভার ড্রাফট (ওডি ঋণ) ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়। এ চার মাস প্রতিষ্ঠান দুটি ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও ব্যাংকটি গ্রাহকদ্বয়ের চলতি মূলধন চাহিদা যাচাই না করেই ঋণ অনুমোদন করে। এছাড়া প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যবসায়িক সাফল্য ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই করা হয়নি। ঋণ প্রস্তাবনায় লিভারেজ রেশিও, অপারেশনাল দক্ষতা ও উপার্জন সক্ষমতা ‘অগ্রহণযোগ্য’ পর্যায়ে রয়েছে। অন্যান্য নির্দেশকগুলো মার্জিনাল পর্যায়ে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রস্তাবনায় ব্রাইটস্টার কোম্পানিটির ১৮.৪৬ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১ টাকা। কোম্পানিটি ২০২৩ সালের জুন মাসের নিট মুনাফা প্রাক্কলন করেছে ২৯.৯৮ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালে ৩৮.৭২ এবং ২০২৫ সালে ৪৫.২৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।

২০২৩ সালের ৩০ জুন তারিখে কোম্পানিটির নেট ওয়ার্থ ৩০.৯৮ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া ২০২৪ সালে ৬৯.৭০ এবং ২০২৫ সালে ১১৪.৯৪ কোটি টাকায় পৌঁছাবে ব্রাইটস্টারের নেট ওয়ার্থ।
একইভাবে, অ্যালট্রন ট্রেডিং কোম্পানির নেট ওয়ার্থ ১৬.৭৯ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১ টাকা। ৩০ জুন ২০২৩ সালে এই কোম্পানির নিট মুনাফার প্রাক্কলন করে ৩০.৬৪ কোটি টাকা। যা ২০২৪ সালে ৩২.৫৪ কোটি এবং ২০২৫ সালে নিট মুনাফা ৩৩.২০ কোটি টাকায় পৌঁছাবে। এছাড়া কোম্পানিটির নেট ওয়ার্থ ২০২৫ সালে ৯৩.৭৯ কোটিতে পৌঁছাবে বলেও প্রাক্কলন করে কোম্পানিটি। অনুসন্ধানে জানা গেছে যে, এ কোম্পানি দুটির এর আগে কোনো ব্যাংক ঋণও ছিল না। তাই কোম্পানিগুলোর সিআইবি পর্যালোচনা করে রিপেমেন্ট বিহ্যাভিয়র যাচাই করা যায়নি।

এ দুটি কোম্পানির করা প্রাক্কলনই বাস্তবসম্মত নয় বলে মতামত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন- ট্রেডিং ব্যবসায়, বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যের বাজারে পণ্য মূল্য নিয়মিত উঠানামা করে। এ অবস্থায় ব্রাইটস্টারের নিট মুনাফা ২৯.১৫ শতাংশ বাড়বে তা যুক্তিসঙ্গত নয়। ছাড়কৃত ঋণের সোর্স অফ রিপেমেন্ট হিসেবে কোম্পানিটির পরিচালকদের নিজস্ব উৎসের কথা উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ, ব্যবসায়ের মুনাফা থেকে ঋণ পরিশোধিত হবে না। এভাবে ররণ প্রদানের নীতি ও অনুশীলন নেই। কোম্পানির পরিচালকদের অন্যান্য ব্যবসার তথ্য যাচাই করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা যাবে না।

এদিকে ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে ১৮২ কোটি ও ১৯৮.৫ কোটি টাকা বাজারমূল্যের লিয়েনকৃত শেয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, সেসব শেয়ার সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রদান করেনি কোম্পানি দুটি। দেশের অস্থিতিশীল শেয়ারবাজাওে মূহুর্তেই শেয়ারের দাম কমে যায়। অপরদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যের বাজারেও পণ্যের দাম নিয়মিত বাড়ে-কমে। এ অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই পণ্য স্টক লট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ব্যবসাটি ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরণের ব্যবসা তীব্র প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় তাতে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান বাজারে টিকে থাকাই কঠিন। তাছাড়া, প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিজ্ঞতা নিতান্ত শূন্যের পর্যায়ে বলেও মন্তব্য করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শাহ আলম সারোয়ারের সঙ্গে। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন লিখে উত্তর চাইলেও কোনো রিপ্লাই করেননি তিনি।

তবে ব্যাংকটির একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, ‘প্রতি নির্বাচনের আগে এমন নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকা বের হয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এসব কোম্পানির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এর আগে ২০১৮ সালেও অস্তিত্বহীন ৩টি কোম্পানি ১২৬৫ কোটি টাকা বের করে নিয়ে যায়।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘একটি কোম্পানিকে ঋণ দিতে হলে সার্বিক তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হয়। ব্যাংকের ঋণ পাওয়ার যোগ্য নয় এমন কোন কোম্পানিকে ঋণ দিলে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংককে জবাবদিহী করতে হবে। আমরা তদন্তে এমন কোনো নামসর্বস্ব কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার তথ্য পেলে ব্যবস্থা নিবো।’

কিন্তু ২০১৮ সালের ১২৬৫ কোটি টাকা অস্বাভাবিক ঋণের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শনে উঠে এলে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শকদের রাতারাতি অন্য বিভাগে বদলি করে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ভালই চলছিল ব্যাংকটি। যদিও নেপালের বেসরকারী ব্যাংক- নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক লি. নামে নেপালে বিশাল অংকের বিনিয়োগ নিয়ে বহুদিনের বিতর্ক ছিল। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান অর্থ মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব এ.আর.এম নাজমুস সাকিব; যিনি একই সাথে আইএফআইসি ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান। আবার, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক এম শাহ আলম সরোয়ার একই সাথে আইএফআইসি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী একইসাথে দুটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকা যায় না।
 

Share This Article


মঙ্গলবার দর পতনের নেতৃত্বে প্রিমিয়ার ব্যাংক

মঙ্গলবার দর বৃদ্ধির নেতৃত্বে এপেক্স ট্যানারি

মঙ্গলবার লেনদেনের নেতৃত্বে সোনালী আঁশ

সোমবার ব্লক মার্কেটে লেনদেনের নেতৃত্বে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ

সোমবার দর পতনের নেতৃত্বে এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইন্সুরেন্স

সোমবার দর বৃদ্ধির নেতৃত্বে জেএমআই সিরিঞ্জ

সোমবার লেনদেনের নেতৃত্বে এশিয়াটিক ল্যাবরটরিজ

রোববার ব্লক মার্কেটে লেনদেনের নেতৃত্বে লাভেলো আইসক্রিম

রোববার দর পতনের নেতৃত্বে এডিএন টেলিকম

রোববার দর বৃদ্ধির নেতৃত্বে বিডি থাই এ্যালুমিনিয়াম

রোববার লেনদেনের নেতৃত্বে মালেক স্পিনিং

দাবদাহে ঢাকায় বছরে ক্ষতি ২৭০০ কোটি ডলার